সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডকে আইনের আড়াল দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। পাশাপাশি ‘নিয়ম রক্ষার’ তদন্ত করা ছাড়া প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই বাজার কারসাজিতে জড়িত কারও বিরুদ্ধে কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়নি সংস্থাটি।
দেশের শেয়ারবাজারের অনিয়ম তদন্তের জন্য গঠিত প্রতিবেদনে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার ভূমিকা পর্যালোচনায় এই অভিমত প্রকাশ পেয়েছে। কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন পেশ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০০৯ ও ২০১০ সালে এসইসি কর্তৃক জারিকৃত বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন ও নির্দেশনা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রণীত হওয়ার কথা। কিন্তু পুঁজিবাজারের অবস্থা থেকে এটি খুব স্পষ্ট যে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি। ফলে ন্যায়সংগতভাবে প্রশ্ন জাগে, ২০১০ সালে জারিকৃত ৮১টি বিজ্ঞপ্তি এবং পূর্ববর্তী বছরগুলোতে অনুরূপ অসংখ্য বিজ্ঞপ্তি কাদের স্বার্থে জারি করা হয়েছিল।’
কমিটি তাদের পর্যালোচনায় আরও বলেছে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে সিকিউরিটি ইস্যু নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে এসইসি শেয়ার-সংক্রান্ত এমন কার্যক্রমে সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছে, যাতে ওই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বস্তুত সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডকে আইনের আড়াল দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এসইসির সার্ভিলেন্স অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট (বাজার পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োগক্ষমতা) যথাযথভাবে কাজ করেনি। দক্ষতা, লোকবল এবং প্রযুক্তির অভাবই একমাত্র কারণ কি না, তা দেখার বিষয় বলে মনে করে কমিটি। কারণ, তদন্তকালে এসইসির কিছু কর্মকর্তার স্বার্থের সংঘাত, চাপের কাছে নতি স্বীকার, এমনকি দুর্নীতির প্রচুর অভিযোগ এসেছে, যা আরও গভীরভাবে অনুসন্ধানের দাবি রাখে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
নিয়ম রক্ষার তদন্ত: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিএমসি কামাল, চিটাগং ভেজিটেবল ইত্যাদি জেড শ্রেণীর শেয়ারের অব্যাহত অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সময় এসইসি স্টক এক্সচেঞ্জদ্বয়ের মাধ্যমে তদন্ত করালেও তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কোনো জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারেনি বা নেয়নি।
কমিটি বলছে, চিটাগং ভেজিটেবলের ক্ষেত্রে সার্কুলার ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাজারের লেনদেন দেখানোর কার্যক্রম প্রমাণিত হওয়ার পরও কোনো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একমাত্র এবি ব্যাংককে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করা ছাড়া এবং অতি সম্প্রতি ছয়টি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবসা সাময়িকভাবে স্থগিত করা ছাড়া দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ দায়িত্ব এড়াতে পারে না বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে, স্টক এক্সচেঞ্জদ্বয়ের প্রতিটি তদন্ত প্রতিবেদনের বেশির ভাগ উদ্ঘাটিত হলো, জেড শ্রেণীর শেয়ারের মূল্য কেনাবেচার জন্য মার্জিন রুলের সামান্য ব্যত্যয় ঘটেছে। আর দু-এক ক্ষেত্রে শর্ট সেলিং বা সার্কুলার ট্রেডিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেলেও তা নগণ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেখানে দৃশ্যত বাজারে বিরাট পরিমাণে কারসাজি হচ্ছে, সেখানে এ ধরনের তদন্ত ‘নিয়ম রক্ষা’ মাত্র।
এতে আরও বলা হয়েছে, সিএমসি কামালের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে স্পষ্ট আভাস পাওয়া গেছে যে কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক অতি দ্রুত মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও শুধু ডিএসই থেকে রুটিনমাফিক কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আছে কি না, জানার জন্য কয়েকটি চিঠি দেওয়া হয়। কোম্পানির উদ্যোক্তাদের মধ্যে সরকারি দলের উচ্চপদস্থ সদস্য থাকায় আর কোনো অনুসন্ধান বা তদন্ত করে ঘটনার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়নি।
কমিটি বলেছে, লক্ষণীয় যে অন্যান্য কোম্পানি, যেমন গ্রামীণফোনের ক্ষেত্রে সামান্য লক্ষণীয় মূল্য পরিবর্তন হলেই এসইসি এবং স্টক এক্সচেঞ্জগুলো ব্যাখ্যা তলব করতে তৎপর হয়ে ওঠে।
সংবাদমাধ্যমে বিভিন্নভাবে বাজার কারসাজির ঘটনার বিশদ চিত্র তুলে ধরা হলেও সেগুলোর সত্যতা যাচাইয়ে এসইসি, ডিএসই ও সিএসইর তেমন কোনো ভূমিকা তদন্ত কমিটি দেখতে পায়নি। কমিটি বলেছে, ‘শেয়ারবাজারের সন্দেহজনক লেনদেনের ক্ষেত্রে কোথাকার অর্থ শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁঁছেছে, তা অনুসন্ধান করতে এই সংস্থাগুলো বিশেষ করে, এসইসি কোনো পদক্ষেপই বলতে গেলে নেয়নি। অথচ তদন্ত কমিটি স্বল্প সময়ে এ ধরনের একাধিক ঘটনা প্রমাণসহ উদ্ঘাটন করেছে।’
মনসুর আলমের অনিয়ম: এসইসির সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সদস্য মনসুর আলমের নানা অনিয়ম চিহ্নিত করেছে কমিটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংকের নামে পুঁজিবাজারে অনিয়ম-সংক্রান্ত অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে বা কার্যকলাপ সন্দেহজনক মনে হয়েছে, আপাতত সংগত কারণে সেগুলো পরিদর্শন করা যায়নি। অথচ কমিটির তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে যে বিভিন্ন অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এসইসি এমনকি ডিএসইও বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস পরিদর্শন করেনি। এসইসির সাবেক সদস্য মনসুর আলমের হস্তক্ষেপে এটি ঘটেছে। তাই হস্তক্ষেপের কারণ উদ্ঘাটনে বিস্তারিত তদন্ত প্রয়োজন বলে কমিটি মনে করে।
প্রতিবেদন অনুসারে, একটি ব্রোকারেজ হাউসের সঙ্গে মনসুর আলমের নাম জড়িত এবং এ ব্যাপারে সংবাদও ছাপা হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে যে মনসুর আলমের সহযোগী আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের (ডিএসই সদস্য নং-২৩৪) ডিএমডি রেজাউর রহমান। অথচ ডিএসইর প্রধান নির্বাহী হিসেবে কর্মরত অবস্থায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে এসইসির লিখিত আদেশে তিনি চাকরিচ্যুত হন। পরে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান থেকেও তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত মনসুর আলমের সুপারিশে ২০০৮ সালে তিনি আল-আরাফাহ ব্যাংকে যোগদান করেন। আর ২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর তাঁকে ব্রোকারেজ হাউসের মনোনীত প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়।
তদন্ত কমিটি প্রশ্ন করেছে, এসইসির আদেশে বরখাস্ত একজন ব্যক্তি কীভাবে একটি ব্রোকারেজ হাউসের মনোনীত প্রতিনিধি হতে পারেন?
কমিটি আরও বলেছে, ‘আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, মনসুর আলম এবং রেজাউর রহমানের আন্তসম্পর্কের অভিযোগ আরও বিস্তারিত তদন্তের দাবি রাখে।’
News Source http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-04-12/news/146099
0 comments:
Post a Comment
Thanks For Comment Pediabd Group Web Site. Every Day update News from get PediaBD News. And Update Picture Update All Web Site Visit http://www.yahoobest.com/ or
http://www.pediabd.com/